বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের অভিভাবকদের বর্তমান অবস্থা ও করণীয়
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের অভিভাবকদের বর্তমান অবস্থা ও করণীয়
Executive Director
দূর থেকে দেখলে বোঝা যায় না। শিশুটির চোখে হয়তো হাজার রঙের স্বপ্ন নেই, হয়তো তার হাঁটা কিংবা বলা সময়ের চেয়ে ধীরে হয়, কিংবা সে একটানা এক কথাই বলে চলে বারবার। কিন্তু মা-বাবার চোখে সে পৃথিবীর সব থেকে আলাদা এক ভুবন—একটি বিশেষ শিশুর প্রতিদিনের লড়াইয়ের নাম জীবন।
বাংলাদেশে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পিতা-মাতারা এক নিষ্পেষিত বাস্তবতার সঙ্গী। রাষ্ট্র যে ভাতা দেয়, তা কেবল নামেই—মাসিক মাত্র ৮৫০ টাকা। এই অর্থ দিয়ে একটি শিশুর প্রয়োজনীয় খাবার, ওষুধ তো দূরে থাক, একটি হুইলচেয়ারের এক কোণা পর্যন্ত মেলে না।
এর পাশাপাশি রয়েছে থেরাপির নামে এক ধরণের অর্থনৈতিক নির্যাতন। কিছু কেন্দ্র আছে, যেগুলোতে প্রকৃত পেশাদার থেরাপিস্টের দেখা পাওয়া যায় না। এক বা দুজন দক্ষ থেরাপিস্ট নামমাত্র কাজ করেন, আর বাকি জনবল স্বল্পশিক্ষিত, অনভিজ্ঞ—তাদের হাতে শিশুর যত্ন নয়, বরং অনিশ্চয়তার ভার তুলে দেওয়া হয়। একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের ফি ২০০০ থেকে ৩০০০ টাকা। এই ব্যয় নিয়মিত বহন করা সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
অভিভাবকরা শুধু বাইরের যুদ্ধেই ক্লান্ত হন না, পরিবার নামক আপন ঘরেও বারবার হোঁচট খান। নিকট আত্মীয়, প্রতিবেশী কিংবা এমনকি স্বামী-স্ত্রী একে অপরের পাশে না দাঁড়ালে, সেই ক্লান্তি ধীরে ধীরে হতাশায় রূপ নেয়। অনেক মায়েদের চোখে দেখি, সন্তানকে নিয়েই তার পৃথিবী, কিন্তু সেই পৃথিবীর সীমানায় কেউ নেই।
আর রয়েছে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা—পুনর্বাসনের দুশ্চিন্তা। "আমি না থাকলে, আমার সন্তানের কী হবে?"—এই প্রশ্নটি প্রতিদিন শত শত মা-বাবার বুকের মধ্যে ছুরি চালায়। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নেই কোনো সুস্পষ্ট পুনর্বাসন পরিকল্পনা, নেই কার্যকর সেবা কাঠামো।
তার ওপর রয়েছে জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়। বাজারের প্রতিদিনের চিত্র যেন অভিভাবকদের মুখে বিদ্রুপ হেসে ওঠে—একটা ডিমের দামে যদি একটি থেরাপির খরচ হতো, তাহলে হয়তো সন্তান একটু ভালো থাকত।
করণীয় কী?
১. রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা বাড়াতে হবে: প্রতিবন্ধি ভাতা বৃদ্ধি, বিশেষ থেরাপি কেন্দ্রের কার্যকর তদারকি, পুনর্বাসন পরিকল্পনা এবং মা-বাবার প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
২. বিশ্বস্ত থেরাপি সেন্টার ও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের তথ্য উন্মুক্ত করা: যেন অভিভাবকরা ভুল সিদ্ধান্ত না নেন।
৩. পরিবার ও সমাজের মনোভাব পরিবর্তন: বিশেষ চাহিদার শিশুকে বোঝা নয়, বরং ভালোবাসা ও সম্মানের সাথে গ্রহণ করতে হবে।
৪. স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও ফাউন্ডেশনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে: অভিভাবকদের পাশে থেকে তথ্য, সেবা ও মানসিক সহায়তা দিতে হবে।
৫. আর্থিক সহায়তা ও স্কলারশিপ চালু করা: যেন অল্প আয়ের পরিবারগুলোর সন্তান থেরাপি ও শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়।
শেষ কথা
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন একটি শিশু শুধু একজন মা-বাবার নয়, সে পুরো সমাজের দায়িত্ব। আমরা যদি সত্যিই এক মানবিক সমাজ গড়তে চাই, তবে আমাদের অবশ্যই এই শিশুদের জীবনকে গুরুত্ব দিতে হবে—তাদের অভিভাবকদের লড়াইকে স্বীকৃতি দিতে হবে। এই যুদ্ধে একা লড়ার দিন শেষ হওয়া দরকার—এই পথ যেন হয় আলোর, সম্মানের ও সহমর্মিতার।
ঢাকা ২৭ মে, ২০২৫
Comments
Post a Comment