অটিস্টিক শিশুর আচরণগত সমস্যা ও সমাধান

অটিস্টিক শিশুর আচরণগত সমস্যা ও সমাধান
সাম্প্রতিক সময়ে অটিজম নিয়ে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টির ফলে কোন শিশুর অটিজম সনাক্ত হওয়ার সাথে সাথে পিতা মাতা বা relatives দের মধ্যে এই সমস্যা দ্রুত নিরসনে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করে থাকে। আর অভিভাবক প্রথমেই তার নানাধি আচরণের কথা বলে(যদিও অটিস্টিক শিশু তার জগতে স্বাভাবিক) তার সমাধান চান। কিন্তু প্রথমেই জানতে হবে আচরণের কারণ সমূহ। অটিস্টিক শিশুর আচরণের মূল কারণ যোগাযোগের সমস্যা, যা আমরা শুধু উপর থেকে লক্ষ্য করি, তাদের গভীরে প্রবেশ করতে পারিনা । আইসবার্গ দূর থেকে অল্প দেখায় কারণ পানির উপর এর সামান্য অংশ ভেসে থাকতে দেখা যায় বেশিরভাগই থাকে পানির নিচে। টাইটানিক আইসবার্গে আঘাত করে ধ্বংস হয়েছিল। অটিস্টিক শিশুদের জগৎ ঠিক আইসবার্গের মত। আমরা শুধু বাইরে থেকে তাদের কামড়, অস্থির, চঞ্চল, মাথায় আঘাত করে, অন্যকে আঘাত করে, থুথু দেয় এগুলো লক্ষ্য করি। কিন্তু তাদের নিজেদের জগতে প্রবেশ করতে পারিনা।


প্রায় অর্ধেক অটিস্টিক শিশু কথা বলতে পারেনা, পারলেও ঠিকমত মনের ভাব প্রকাশ বা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনা। আবার অনেক ক্ষেত্রে ইশারা বা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমেও যোগাযোগ করেনা।
সঠিকভাবে ভাষা প্রয়োগ, নিজের অনুভূতি , চিন্তা বা চাহিদা প্রকাশ করতে পারেনা। আবার অনেক ক্ষেত্রে নিজের পছন্দের বিষয় নিয়ে দীর্ঘ সময় কথা বলতে আগ্রহ দেখায়। ঠাট্রা বা বাগধারা বোঝেনা।
সামাজিক আদান প্রদান করতে চাইলেও কিভাবে করতে হবে বুঝে উঠতে পারেনা।কিছু কিছু শিশু সামাজিক হলেও তাদের কথোপকথন স্বাভাবিক হয় না ও বেশিক্ষন চালিয়ে যেতে পারেনা। সমাজে ফাংশন করা তাদের জন্য কঠিন হয়। অন্যদের সাথে বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক স্থাপন , আদান প্রদান মূলক খেলা, চোখে চোখে তাকানো, সামাজিক হাসি বিনিময় এসবে তাদের সমস্য থাকে।


তারা এই সমস্যাগুলোর কারণে তাদের নিজেদের আবেগ, অনুভূতি, চাহিদা, দুঃখ আনন্দের প্রকাশ ঘটায় নানা বিধ (বিকল্প আচরণের মাধ্যমে) অনাকাংখিত আচরণের মাধ্যমে যেমন অত্যন্ত চঞ্চল ও অস্থির থাকা, সারারাত না ঘুমিয়ে ভোরের দিকে ঘুমাতে যাওয়া, থুথু দেওয়া, বিভিন্ন জিনিস ছুড়ে ফেলে দেওয়া, কাউকে হঠাৎ আঘাত করা, নিজ হাতে কামড়ানো, নিজ মাথায় আঘাত করা, অন্যকে আঘাত করা ইত্যাদি । অটিস্টিক শিশুরা সাধারণত যোগাযোগ করে অন্যের হাত ধরে, প্রয়োজনীয় জিনিসের কাছে গিয়ে, বিভিন্ন আচরণ করে ইত্যাদি । তাদের যোগাযোগের ধরনের উপর ভিত্তি করে তাদের প্রয়োজন, আকাংখা, অনুভূতি বোঝার বিষয়ে শিক্ষক ও অভিভাবককে সচেষ্ট থাকতে হবে তাহলেই তাদের যোগাযোগটা কার্যকরী হবে আর এর ফলে তাদের অনাকাংখিত আচরণ অনেকাংশে নিরসন হবে ।
তাদের অনাকাংখিত আচরণ নিরসন করে যোগাযোগের দক্ষতা বাড়াতে তাদের জন্য নানাবিধ যোগাযোগের বিকল্প উপায় তৈরি করে দিতে হবে। আর নিচের বিষয়গুলো মনোযোগ সহকারে লক্ষ করতে হবে।
তার কোন সেনসরি সমস্যা আছে কি না তা জানতে হবে। যেমন যে কোন শব্দই তার কানে উচুঁ ভলিউমের মিউজিকের মত শোনাচ্ছে। আপনার বেডরুমের লাইটটা হাই পাওয়ার সার্চ লাইটের মত চোখে পীড়া দিচ্ছে। আবার তার পরনের কাপড়টা গায়ে স্পর্শ করলেই শিরিষ কাগজের মত খসখসে লাগছে ইত্যাদি ।
a. প্রচুর পরিমান ছবি ব্যবহার করতে হবে। তার প্রয়োজনীয় জিনিস/চাহিদাা যাতে আপনাকে ছবি দেখিয়ে বোঝাতে পারে তার জন্য প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
b. অটিস্টিক শিশুরা ভিজুয়াল লার্নার, তারা কল্পনা করতে পারে না তাই তাদের সাথে কাজ করার ক্ষেত্রে ভিজুয়্যাল সিডিউল/কার্ড ব্যবহার করতে হবে । যেমন সকালে ঘুম থেকে উঠার পর থেকে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সে কখন কি করবে তার জন্য ছবি দিয়ে রুটিন তৈরি করে দেওয়া(অক্ষর চিনলে ছবি ব্যাবহার না করে টেক্সট ব্যবহার করা। )
c. ছবি ব্যবহার করে পছন্দের একটা তালিকা তেরি করা।(যেমন পছন্দের খেলনা, খাবার, জায়গা, ব্যক্তি ইত্যাদি)
d. ছবি ব্যবহার করে অপছন্দের তালিকা তৈরি করা (যেমন পছন্দের খেলনা, খাবার, জায়গা, ব্যক্তি ইত্যাদি)
e. যে কোন ঘটনা, বিষয়, অনুষ্ঠান, পরিস্থিতি, সামাজিক বা ব্যক্তিগত আচরণ, ব্যক্তিগত পরিস্কার, পরিচ্ছন্নতা (যেমন দাঁত ব্রাশ, চুল কাটানো/ আচড়ানো, নখ কাটা, জন্মদিনের পার্টিতে কি করতে হয়, কোথাও বেড়াতে গেলে কিভাবে যাবেন, কখন যাবেন, কোথায় থাকবেন, কি খাবেন, কখন ফিরবেন ) ইত্যাদি বিষয়ে সোশ্যাল স্টোরি ব্যবহার করতে হবে।
f, টয়লেটে না যাওয়ার সমস্যা থাকলে, ট্রেনিং দিতে হবে। টয়লেট ভিতি থাকলে টয়লেটকে আকর্ষণীয় করে তোলা যেমন টয়লেটের ভিতরে সুন্দর সুন্দর বাচ্চার ছবি, কার্টুন, মজার খেলনা ইত্যাদি যা দেখে সে টয়লেটে যেতে আগ্রহী হবে
g. নাউ নেক্সট কার্ড ব্যবহার করতে হবে(্যদি ছবি আঁকতে থাকে, ছবি আঁকার পরে সে কি করবে তা উল্লেখ থাকতে হবে)
h. যে কোন ভাল কাজ, আচরণ, কথা, শব্দ ইত্যাদির জন্য তাকে পুরস্কৃত করতে হবে( যেমন পছন্দের খেলনা, খাবার বা বাইরে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি)
i. অটিস্টিক শিশু যে বিষয়ে তার দক্ষতা প্রকাশ ঘটায় তাকে সেটা শেখানোর উপর আরও গুরুত্ব দেওয়া।
j. অটিস্টিক শিশুর যোগাযোগের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া যেমন সে যদি বিস্কুট চায় আপনি তাকে বিস্কুটের টিন বা জার দেন যাতে সে সেটার মুখ খোলার চেষ্টা করে বা আপনার সাহায্য চায়।
k. তাদের জন্য হেলপ কার্ড ব্যবহার করা যাতে সে নিজের প্রয়োজনে অন্যদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে।
l. একটা, দুইটা শব্দ ব্যবহার করে তার ভাষাগত/শব্দগত যোগাযোগ দক্ষতা বাড়ান যেমন. ’রাফি পানি খাবে’ না বলে বলেন ’পানি’
m. রোল প্লে বা অভিনয় করে দেখান
n. শব্দ বলার ক্ষেত্রে তাকে আরও বেশি শব্দ বলতে পারে তার সুযোগ করে দিন। সে যদি গাড়ি চায় আপনি একটি লাল/নীল গাড়ি দিয়ে বলুন ‘লাল/নীল গাড়ি’
o. এবিসি(ফাংশনাল বিহেভিয়্যার এ্যাসেসমেন্ট) ফরম ব্যবহার করতে হবে কোন আচরনের আগের কারণ চিহিœত করতে হবে, আচরণ নিরসনে কি করা হয়েছিল এর ফলে অটিস্টিক ছেলে মেয়ে কি আচরণ করেছিল ইত্যাদি বিষয়গুলো নোট রাখতে হবে।
p. স্বাস্থ্যগত কোন সমস্যা আছে কিনা তা জানতে হবে।
q. অটিস্টিক ছেলে/মেয়ে যদি বয়োপ্রাপ্ত হয় তাহলে তার সেই অনুভূতি বা শারীরিক প্রয়োজন নিরসনে সহযোগিতা করতে হবে।


অটিস্টিক শিশুকে নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে তার অটিজম আছে এটা মাথায় রেখে, ধৈর্যসহকারে সময় নিয়ে শেখাতে হবে। অন্য কোন ছেলে মেয়ের সাথে তার তুলনা না করে তার নিজের মধ্যে যে দক্ষতা আছে সেটা খুঁজে বের করতে হবে। পিয়ারগ্রুপ ্এ্যাকটিভিটি বা খেলার মাধ্যমে অটিস্টিক শিশুরা বেশি শেখে আর এ সব কিছুই তার দৈহিক, মানসিক প্রশস্তি দান করে এবং তার আচরণ ও স্বাভাবিক হতে সাহায্য করে।
মোঃ মফিজুল ইসলাম

Comments

Popular posts from this blog

Founders of Moonflower Autism

General Meeting

MOONFLOWER AUTISM FOUNDATION